উচ্চ-গতির রেল
উচ্চ-গতির রেল বা হাই-স্পিড রেল (ইংরেজি: high-speed rail) সাধারণত কমপক্ষে ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৬০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চলে। অবশ্য পুরনো রেললাইনে ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১২০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চললে এগুলোকেও উচ্চগতির রেল গণ্য করা হয়। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এই গতি এখনও বেশ নিম্ন গতির হিসেবে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে সর্বনিম্ন কোন গতিকে চললে উচ্চ-গতির রেল বলা হবে তার কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।[১]
প্রথম উচ্চগতির রেল ১৯৬৪ সালে জাপানে চলাচল শুরু এবং এটি ব্যাপকভাবে বুলেট ট্রেন হিসাবে পরিচিত। এর গতিবেগ বর্তমানে ৩২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (২০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা)। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, তাইওয়ান, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং উজবেকিস্তানসহ বহু দেশ প্রধান শহরগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে উচ্চ গতির রেল তৈরি করেছে। শুধুমাত্র ইউরোপে। উচ্চগতির রেল বা এইচএসআর আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে। প্যারিস থেকে ব্রাসেলস হয়ে আমস্টারডাম অবধি থ্যালিস ট্রেনটি ৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৯০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতিতে চলে। লন্ডন-প্যারিস বা প্যারিস-ব্রাসেলস ইউরোস্টার ট্রেনের গতি ২৯৯ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৮৬ মাইল প্রতি ঘণ্টা)।
ডিসেম্বর ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ চীনে ২২,০০০ কিলোমিটার (১৪,০০০ মাইল) এইচএসআর বা উচ্চ-গতির রেলপথ রয়েছে, যা বিশ্বের মোট উচ্চ-গতির রেলপথের দুই-তৃতীয়াংশ।[২] সব উচ্চগতির রেল বিদ্যুৎ চালিত। উচ্চ গতির ট্রেন সাধারণত পথের ডানদিকে গ্রেড-বিচ্ছেদ রেলপথকে ক্রমাগত ঝালাই দ্বারা সংযুক্ত করে সাধারণ গেজ ট্র্যাকগুলিতে পরিচালনা করা হয় যা রেলপথের নকশায় একটি বড় ব্যাসার্ধের বাঁক সংযোজন করে।
সংজ্ঞা
[সম্পাদনা]উচ্চগতিসম্পন্ন রেলের জন্যে বহুমুখী সংজ্ঞাগুলো পৃথিবীব্যাপী ব্যবহার হয়।
দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডাইরেক্টিভ ৯৬/৪৮/ইসি, অ্যানেক্স ১ উচ্চগতিসম্পন্ন রেল হল নিম্নরূপ:
- পরিকাঠামো: উচ্চগতিসম্পন্ন যাত্রার জন্যে লাইন তৈরি অথবা উচ্চগতিসম্পন্ন যাত্রার জন্যে বিশেষভাবে আধুনিকীকৃত।
- কমপক্ষে গতি: ২৫০ কিমি/ঘণ্টা (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা) উচ্চগতিসম্পন্ন যাত্রার জন্যে লাইনের ওপর প্রায় ২০০ কিমি/ঘণ্টা (১২৪ মাইল/ঘণ্টা) স্থায়ী লাইনের ওপর যেটা বিশেষভাবে আধুনিকীকৃত। এটা অন্তত লাইনের একাংশে অবশ্যই প্রয়োগ করা উচিত। রেল লাইনের ওপর যানসমূহ যেন কমপক্ষে ২০০ কিমি/ঘণ্টা (১২৪ মাইল/ঘণ্টা)উচ্চগতি বজায় রাখতে পারে।
- চালনার অবস্থাসমূহ: রেল লাইনের পরিকঠামোর পাশাপাশি তার ওপর যানসমূহের নকশা এমনভাবে হবে যাতে সম্পূর্ণ সুসঙ্গতি, সুরক্ষা এবং পরিসেবার মান বজায় থাক।[৩]
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ রেইলওয়েজ (ইউআইসি) তিন ধরনের উচ্চগতিসম্পন্ন রেল শনাক্তকরণ করেছে:[৪]
- শ্রেণী: ১ - নতুন লাইন বিশেষভাবে উচ্চগতির জন্যে তৈরি, কমপক্ষে ২৫০ কিমি/ঘণ্টা (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা) চলন্ত গতি ধারণক্ষম।
- শ্রেণী: ২ - স্থায়ী লাইন উচ্চগতির জন্যে আধুনিকীকৃত, কমপক্ষে ২০০ কিমি/ঘণ্টা (১২৪ মাইল/ঘণ্টা) চলন্ত গতি ধারণক্ষম।
- শ্রেণী: ৩ – স্থায়ী লাইন উচ্চগতির জন্যে আধুনিকীকৃত, অধিকতম চলন্ত গতি অন্ততপক্ষে ২০০ কিমি/ঘ (১২৪ মা/ঘ), কিন্তু কিছু অঞ্চলের কম ধারণক্ষম গতির সঙ্গে (উদাহরণস্বরূপ, ভূসংস্থানিক বাধা, অথবা গ্রাম্য জায়গার মধ্যে দিয়ে যাওয়া)।
উচ্চগতি এবং খুব উচ্চগতিসম্পন্ন রেলের একটা তৃতীয় বিবরণের (ডেমিরিডস এবং পিরজিডিস ২০১২) জন্যে একই সঙ্গে নিম্নবর্ণিত দুটো অবস্থার সমাধানের দরকার হয়:[৪] ১ উচ্চতম অর্জনক্ষম চলন্ত গতি হল ২০০ কিমি/ঘ (১২৪ মা/ঘ)এর বাড়তি, অথবা ২৫০ কিমি/ঘ (১৫৫ মা/ঘ)} অতি খুব উচ্চগতির জন্যে, ২ যাত্রাপথের বিপরীতে গড় চলন্ত গতি হল ১৫০ কিমি/ঘ (৯৩ মা/ঘ)এর বাড়তি, অথবা ২০০ কিমি/ঘ (১২৪ মা/ঘ) অতি খুব উচ্চগতির জন্যে। ইউআইসি 'বিবরণগুলো' (বহুবচনে) ব্যবহার করতে পছন্দ করে, কারণ তাদের মত অনুযায়ী কোনো একটা গুণমানের উচ্চগতির রেলের বিবরণ নেই, এমনকি ('উচ্চগতি' অথবা 'খুব উচ্চগতি') গুণমানগত কথাও ব্যবহার হয়না। তারা ইউরোপীয় ইসি নির্দেশক ৯৬/৪৮ ব্যবহার করে থাকে এই বলে যে, উচ্চগতি হল পরিকাঠামো, রেললাইন এবং চালনার অবস্থাসমূহের সম্মিলিত উপাদানে গঠিত। [৩] ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ রেইলওয়েজ ঘোষণা করে যে, উচ্চগতির রেল শুধুই একটা বিশেষ গতির ওপর চলন্ত ট্রেন নয়, এটা হল একটা অনন্য সম্যক বৈশিষ্ট্য। অনেক গতানুগতিক ট্রেন ২০০ কিমি/ঘ (১২৪ মা/ঘ) ব্যবসায়িক পরিসেবা দিয়ে যায়, কিন্তু তাদের উচ্চগতির রেল বলা যাবেনা। এগুলোর মধ্যে আছে ফরাসি SNCF Intercités এবং জার্মান DB IC। নানা কারণে গুণগত মান ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১২০ মা/ঘ) বিচার্য হয়; এর মধ্যে গতি, জ্যামিতিক গোলমাল নিবিড়ীকৃত, লাইনের লেগে থাকায় কমতি, বায়ুগতির বাধা ভীষণভাবে বেড়ে যাওয়া, সুড়ঙ্গের মধ্যে চাপের তারতম্যে যাত্রীদের অস্বাচ্ছন্দ্য, এবং এর ফলে চালকদের পক্ষে লাইন-ধারের সঙ্কেত যাচাইয়ে অসুবিধে।[৪] চলতি সঙ্কেত যন্ত্রপাতি প্রায়ই ঐতিহ্যপূর্ণ সীমার সঙ্গে ২০০ কিমি/ঘণ্টার নিচে গতি সীমাবদ্ধ রাখে, আমেরিকায় ৭৯ মা/ঘ (১২৭ কিমি/ঘ), জার্মানিতে ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ) এবং ব্রিটেনে ১২৫ মা/ঘ (২০১ কিমি/ঘ)। ওই গতির ওপর positive train control অথবা European Train Control System দরকার হয় অথবা আইনত বাধ্যতামূলক। জাতীয় দেশীয় গুণমানগুলো আন্তর্জাতিকের থেকে আলাদা হতে পারে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]স্থলে বা জমিতে দ্রুত পরিবহনের প্রথম রূপ ছিল রেলপথ এবং ২০ তম শতাব্দীর প্রথম দিকে মোটর গাড়ি এবং বিমানের বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রী পরিবহনে উপর একছত্র অধিকার ছিল রেলপথের। গতি সবসময় রেলপথ জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এবং ক্রমাগত উচ্চ গতি অর্জন এবং ভ্রমণের সময় কমাতে চেষ্টা করেছে রেলপথ নির্মাতারা। ১৯ শতকের শেষের দিকে রেল পরিবহনটি নিন্ম গতির ট্রেনের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল ছিল না এবং অনেক রেলপথ নিয়মিত তুলনামূলকভাবে দ্রুত এক্সপ্রেস ট্রেন চালায়, যার গতিবেগ ছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা (৬২ মাইল)। [5]
প্রারম্ভিক গবেষণা
[সম্পাদনা]প্রথম পরীক্ষা
[সম্পাদনা]১৮৯৯ সালে জার্মানিতে উচ্চ গতির রেল বিকাশ চালু হয়, যখন প্রুশিয়ান রাষ্ট্রীয় রেল দশটি বিদ্যুৎ ও প্রকৌশল সংস্থাগুলির সাথে যোগ দেয় এবং মারিনফিল্ড এবং জোসেনের মধ্যে সামরিক মালিকানাধীন রেলপথের ৭২ কিলোমিটার (৪৫ মাইল) বিদ্যুতায়িত হয়। রেলপথটি ১০ কিলোভোল্ট এবং ৪৫ হার্জের তিন ফেজের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ব্যবহার করত।
দেউজ, কোলন-এর ভান ডার জয়পেন অ্যান্ড চারলির কোম্পানী দুটি রেলগাড়ি তৈরি করেছিল, একটি সিমেন্স-হালসকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দিয়ে, অন্যটি অ্যালজিমাইন ইলেক্ট্রিক্টটস-গেসেলসচফ্ট (এএজি) থেকে নেওয়া যন্ত্রপাতি দিয়ে, যা ১৯০২ এবং ১৯০৩ সালে মারিয়েনফিল্ড-জোসেন লাইনের পরীক্ষায় পাশ হয়।
২৩ শে অক্টোবর, ১৯০৩ সালে, এস এন্ড এইচ-সজ্জিত রেলগাড়ির গতি ২০৬.৭ কি.মি./ঘণ্টা (১২৮.৪ মাইল) এবং ২৭ অক্টোবর, এইজি-সজ্জিত রেলগাড়ির গতি ২১০.২ কিমি/ঘণ্টা (১৩০.৬ মাইল) অর্জন করে। [৫] এই ট্রেনগুলি বৈদ্যুতিক উচ্চ গতির রেল ব্যবস্থার সম্ভাব্যতা প্রদর্শন করেছে; যাইহোক, নিয়মিত বিদ্যুৎ গতির রেল ভ্রমণ ৩০ বছরেরও বেশি দূরে ছিল।
উচ্চগতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা
[সম্পাদনা]রেলপথের বৈদ্যুতিকীকরণের সাফল্যের পর, এটা ছিল স্পষ্টভাবে পরিকাঠামো - বিশেষভাবে এর মূল্য - যেটা উচ্চগতির রেল উদ্ভাবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। নানারকম আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল - রেলের লাইনচ্যুতি, একক লাইনে মুখোমুখি সংঘর্ষ, সড়কপথের সংযোগস্থলে সংঘর্ষ, ইত্যাদি। বাস্তব নিয়মগুলো সকলের জানা, যেমন, গতি যদি দ্বিগুণ হয়, বক্ররেখা ব্যাসার্ধ চৌগুণ হবে; গতিবৃদ্ধি এবং গতিরোধের দূরত্বের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকমভাবে সত্যি।
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ার কারোলি জিপারনওস্কি ভিয়েনা-বুদাপেস্ট লাইনে একটা উচ্চগতির রেললাইনের প্রস্তাব করেন ২৫০ কিমি/ঘ (১৬০ মা/ঘ)এতে বৈদ্যুতিক রেলের আয়ত্তে আনার জন্যে। [৬] ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ড.ওয়েলিংটন অ্যাডামস শিকগো থেকে সেন্ট লুইসে ২৫২ মাইল (৪০৬ কিমি) একটা air-lineএর প্রস্তাব করেন। [৭] গতি ছিল মাত্র ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ), জেনারেল ইলেক্ট্রিকের মত অনুযায়ী তিনি জিপারনওস্কির চেয়ে অনেক বাস্তববাদী এবং আধুনিক ছিলেন।
সম্ভবত, প্রথম উচ্চগতির লাইন ছিল ম্যারিয়েনফেল্ড-জোসেন মিলিটারি রেইলওয়ে ৭২ কিমি (৪৫ মা), প্রুশিয়ান স্টেট রেইলওয়ের মালিকানায়, এবং ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষামূলকভাবে বৈদ্যুতিক রেলগাড়ি চালু করা হয়।
আলেকজান্ডার সি. মিলারের মহোত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চালু করেন Chicago-New York Electric Air Line Railroad প্রকল্প, যেটা দুটো বড়ো শহরের মধ্যবর্তী যাতায়াতের সময় বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের রেল ব্যবহার করে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত কমাবে ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ)। সাত বছরের চেষ্টার পর, যাহোক, ৫০ কিমি (৩১ মা) কমে তিরের মতো সোজা লাইন তৈরি শেষ হয়।[৭] এই লাইনের একাংশ এখনো আমেরিকায় শেষ আন্তঃশহরের একটা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
উচ্চগতি আন্তঃশহরসমূহ
[সম্পাদনা]আমেরিকায় বিশ শতকের গোড়ায় সেযুগের মানুষের পক্ষে উচ্চগতিসম্পন্ন আন্তঃশহরের গাড়ি (যার অর্থ ট্রাম অথবা রাস্তার গাড়ি যেগুলো এক শহর থেকে অন্য শহরে চলত) (এবং ইউরোপেও তখন এরকম আন্তঃশহরের গাড়ি চলত)। আন্তঃশহর ক্ষেত্রে বিভিন্ন উচ্চগতির রেল প্রযুক্তি তাদের আসলরূপে ছিল। প্রথাগত রেলপথে তাদের যাত্রাপথ সচল রাখার জন্যে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে লুইসিয়ানা পার্চেজ এক্সপোজিশন একটা ইলেক্ট্রিক রেলওয়ে টেস্ট কমিশন সংগঠিত করে ধারাবাহিক পরীক্ষা চালায়, রেলের কামরার নকশার উন্নয়নে যাতে উচ্চগতির সময় বাতাসের বাধা সামলানো যায়। এক লম্বা ধারাবাহিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছিল।[৮] ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট লুই কার কোম্পানি চুম্বক আকর্ষণের জন্যে একটা রেলগাড়ি বানিয়েছিল হেনরি ই হান্টিংটন, যাতে গতিকে সামলানো যায়।১৬০ কিমি/ঘ (১০০ মা/ঘ) একবার যখন এটা লস অ্যাঞ্জেলেস এবং লং বিচের মধ্যে ৩২ কিমি (২০ মা) ১৫ মিনিটে চলত, একটা গড় গতি ছিল ১৩০ কিমি/ঘ (৮০ মা/ঘ)।[৯] যাইহোক, বেশির ভাগ লাইনের পক্ষে এটা ছিল অত্যন্ত ভারী, সুতরাং সিনসিনাটি কার কোম্পানি, জে জি ব্রিল এবং অন্যান্যরা অল্প ভারী কাঠামোতে অগ্রগণ্য, অ্যালুমিনিয়াম সংকর, এবং কম উচ্চ বগিসমূহ যেগুলো ধাপাড়ে আন্তঃশহর লাইনে অত্যন্ত উচ্চগতিতে সাবলীলভাবে চালানো যেত। ওয়েস্টিংহাউস এবং জেনারেল ইলেক্ট্রিক এরকম বগির ওপর সন্নিবিষ্টভাবে আটকানো মোটরের নকশা করেছিল। ১৯৩০ থেকে চালু, সিনসিনাটি কার কোম্পানি এবং অন্য আন্তঃশহর রেলগাড়িগুলো রেড ডেভিলস ব্যবসায়িক যাতায়াতে পৌঁছেছিল প্রায় ১৪৫ কিমি/ঘ (৯০ মা/ঘ)। রেড ডেভিলের ওজন মাত্র ২২ টন, যদিও তাতে ৪৪ জন যাত্রীর আসন ছিল। ব্যাপক বায়ু সুড়ঙ্গ গবেষণা - রেলপথ শিল্পে প্রথম - ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে জে জি ব্রিলের আগে ফিলাডেলফিয়া অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন রেলবোর্ড (পিঅ্যান্ডডব্লু)-এর জন্যে বুলেট ট্রেন তৈরি করে। সেগুলো চলতে সক্ষম ছিল ১৪৮ কিমি/ঘ (৯২ মা/ঘ)।[১০] তার মধ্যে কিছু ৬০ বছরের কাছাকাছি পরিসেবায় ছিল। পিঅ্যান্ডডব্লু-এর নরিসটাউন হাই স্পিড লাইন এখনো ব্যবহার হয়, মোটের ওপর ১১০ বছর পর পিঅ্যান্ডডব্লু ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাদের একক গ্রেড ছাড়া রেলপথ অথবা অন্য রাস্তার ক্রসিংয়ে আপার ডার্বি-স্ট্র্যাফোর্ড ডবল লাইন খুলে দেয়। পুরো লাইনটাই একটা ব্লক সিগনাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হোত।[১১]
গোড়ার যুগে জার্মান উচ্চগতি জালবুনুনি
[সম্পাদনা]১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে, ডয়েটশ রিশবান-গেসেলশফ্ট কোম্পানি পেশ করে ডিজেল-চালিত "ফ্লাইজেন্ডার" হামবুর্গ এবং বার্লিন নিয়মিত রেল পরিসেবা (২৮৬ কিমি অথবা ১৭৮ মা), তার ফলে নিয়মিত পরিসেবায় একটা নতুন উচ্চগতি, ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ)-এর সঙ্গে উচ্চগতি পায়। এটা ছিল একটা বহুমুখী শক্তির ইউনিটসহ স্বাভাবিক গতির ট্রেন, তাহলেও ডিজেল, এবং এতে ব্যবহার হোত জেকবস বগিসমূহ।
হামবুর্গ লাইনের সফলতা দেখে, বাষ্পশক্তিচালিত হেনশেল-বেগমান ট্রেন উন্নত করা হয়েছিল এবং বার্লিন থেকে ডার্সডেন পরিসেবা নিয়মিত ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ) সর্বোচ্চ গতিতে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে চালু করা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এই এক্সপ্রেস ট্রেনের বাতিলকরণের সময় থেকে কোনো দ্রুতগতির ট্রেন ২০১৮-এর হিসাব অনুযায়ী[হালনাগাদ] ওই দুই শহরের মধ্যে যাতায়াত করেনি। পরবর্তী উন্নয়ন পুরো জার্মানির রেল জালবুনুনিতে এই "ফ্লাইজেন্ডেন জুগে" (উড়ন্ত ট্রেনসমূহ)-এর ব্যবহার স্বীকৃত হয়েছিল।[১২] "ডিজেল-স্ক্নেলট্রিবওয়াগন-নেটজ্" ১৯৩৪ খ্রস্টাব্দের পরিকল্পনায় ছিল, কিন্তু কখনোই এটা উক্ত পরিকাঠামোয় আসেনি।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অগস্ট মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার সামান্য পূর্বে সমস্ত উচ্চগতির রেল পরিসেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।[১৩]
মার্কিন প্রবাহরেখাগুলো
[সম্পাদনা]ফ্লাইজেন্ডার হামবার্গার চালু হওয়ার এক বছর পর, ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মে, বার্লিংটন রেলপথ তাদের নতুন প্রবাহরেখা ট্রেনের সঙ্গে দূর পাল্লায় একটা গড় গতি স্থির করেছিল জেফির ১২৪ কিমি/ঘ (৭৭ মা/ঘ)তে, সঙ্গে উচ্চতম গতি ১৮৫ কিমি/ঘ (১১৫ মা/ঘ)। জেফির তৈরি হয়েছিল স্টেইনলেস স্টিলে, এবং ফ্লাইজেন্ডার হামবার্গারের মতো ডিজেল-চালিত, জেকবস বগির সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ করা ও ওটা ব্যবসায়িকভাবে ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ)তে পৌঁছেছিল।
কানসাস সিটি এবংলিঙ্কনএর মধ্যে নতুন পরিসেবা উদ্বোধন হয় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর, কিন্তু নথিভুক্ত গতির থেকে কম, গড় গতি ৭৪ কিমি/ঘ (৪৬ মা/ঘ)তে চলত। [১৪]
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে মিলৌকি রোড বাষ্পীয় রেলগাড়ি দিয়ে ১৬০ কিমি/ঘ (৯৯ মা/ঘ)তে টেনে মর্নিং হিয়াওয়াদা পরিসেবা চালু করে। এগুলো ছিল বাষ্প শক্তি ব্যবহার করা শেষ 'উচ্চগতি' ট্রেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে, যমজ শহরগুগুলো জেফির শিকাগো থেকে মিনিয়াপোলিস, গড় গতি ১০১ কিমি/ঘ (৬৩ মা/ঘ)এর সঙ্গে পরিসেবার আওতায় আসে।[১৫]
এই প্রবাহরেখাগুলোর মধ্যে অনেকেই যে ভ্রমণের সময় দিয়েছিল, এমনকি তাদের আধুনিক অ্যামট্রাক উত্তরাধিকারীদের চেয়েও ভালো, বেশির ভাগ জালবুনুনিতে যেটা সীমাবদ্ধ ১২৭ কিমি/ঘ (৭৯ মা/ঘ) উচ্চগতি ছিল।
বাজার
[সম্পাদনা]ফ্রান্স, জাপান, স্পেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চগতির রেলের চিহ্নিত প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, বৃহৎ শহরগুলির সংযুক্ত করা। ফ্রান্সে এটি ছিল প্যারিস-লায়ন, জাপানে টোকিও-ওসাকা, স্পেনে মাদ্রিদ-সেভিল (তারপর বার্সেলোনা)। ইউরোপীয় ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে, শহুরে সাবওয়ে ও রেলপথের ঘন নেটওয়ার্কগুলির উচ্চ গতির রেল লাইনের সাথে যোগাযোগ রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া
[সম্পাদনা]ভারত
[সম্পাদনা]১৯৮০-এর দশক থেকে ভারতে একটি উচ্চ গতির রেল ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয় যখন রেল মন্ত্রণালয় সংসদে বিল উত্থাপনের সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চগতির রুট নিয়ে আলোচনা করার জন্য "দৃষ্টি ২০২০" প্রস্তাব জমা দেয়। এইচএসআর নেটওয়ার্ক নির্মাণের সাথে জড়িত সমস্ত প্রচেষ্টার জন্য ২০১৩ সালে হাই স্পিড রেল কর্পোরেশন (এইচএসআরসি) স্থাপন করা হয়েছিল। উচ্চগতির রেলপথ নির্মাণের চুক্তি জাপানকে দেওয়া হয়েছিল। মুম্বাই আহমেদাবাদ উচ্চগতির রেলপথ প্রথম পর্যায় নির্মাণের পরিকল্পনা ১৪ সেপ্টেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কর্তৃক শুরু হয় এবং ২০২২ সালে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই লাইনে ট্রেনের গতিবেগ ৩২০ কিলোমিটার/ঘণ্টা হবে। বর্তমানে, ভারতের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেনটি হল গতিমান এক্সপ্রেস (সর্বোচ্চ গতিবেগ-১৬০ কিমি/ঘণ্টা) যা উচ্চ গতির ট্রেনের শ্রেণীতে নেই, যদিও ট্রেনের ইঞ্জিনটি তাত্ত্বিকভাবে ২০০ কিলোমিটার/ঘণ্টার গতি অতিক্রম করতে সক্ষম।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "General Definitions of Highspeed"। International Union of Railways (UIC)। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ "China's high speed railway exceeds 20,000 km"। China Daily। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০১৭।
- ↑ ক খ "General definitions of highspeed"। International Union of Railways। ২০ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০০৯।
- ↑ ক খ গ Pyrgidis, Christos N. (২১ এপ্রিল ২০১৬)। Railway Transportation Systems: Design, Construction and Operation। CRC Press। আইএসবিএন 978-1-4822-6216-2।
- ↑ Sith Sastrasinh, "Electrical Train Marienfelde–Zossen in 1901 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে", 21 January 2000, WorldRailFans. Accessed 23 January 2013.
- ↑ Krettek 1075, পৃ. 47।
- ↑ ক খ Middleton 1968, পৃ. 27।
- ↑ Middleton 1968, পৃ. 68।
- ↑ Middleton 1968, পৃ. 60।
- ↑ Middleton 1968, পৃ. 72।
- ↑ Middleton 1968, পৃ. 10।
- ↑ de:Datei:Vorkriegseinsatz1.jpg
- ↑ Geschichte und Zukunft des Verkehrs.: Verkehrskonzepte von der Frόhen ... (জার্মান ভাষায়)। ১৯৯৭। আইএসবিএন 9783593357669। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মার্চ ২০১৩।
- ↑ Eric H. Bowen। "The Pioneer Zephyr – September, 1938 – Streamliner Schedules"। ২১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ Eric H. Bowen। "The Twin Zephyrs – September, 1938 – Streamliner Schedules"। ২১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪।